বর্তমান বিশ্বের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে আমরা এক গভীর সংকটকাল অতিক্রম করছি।
প্রযুক্তির বিকাশ, স্থাপত্য নির্মাণের চমক ও অর্থনৈতিক চাঞ্চল্য আমাদের চোখ ধাঁধানো হলেও আসল সত্য হলো, মানবতা আজ ভীষণ রকম ঝুঁকির মধ্যে। বিশ্ব নেতারা আজ উন্নয়নের নামে যে দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মপন্থা গ্রহণ করছেন, তা কেবল বাহ্যিক অর্জনের দিকে কেন্দ্রিক; অথচ আত্মিক, নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধগুলো প্রতিনিয়ত উপেক্ষিত হচ্ছে।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এখন অনেকাংশেই একটি প্রতিযোগিতামূলক খেলার মতো, যেখানে দেশের সাফল্য পরিমাপ করা হচ্ছে জিডিপি, প্রযুক্তিগত অগ্রগতি ও সামরিক শক্তির মাত্রায়। এই প্রবণতা আমাদের এমন এক চোরাবালির দিকে ঠেলে দিচ্ছে, যার শেষ নেই শান্তি বা নিরাপত্তায়, বরং দুঃখ, যুদ্ধ, দারিদ্র্য এবং সামাজিক অস্থিরতায়।
বিশ্বের বহু উন্নত রাষ্ট্র আজ বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ব্যয় করছে অস্ত্র প্রতিযোগিতা, পারমাণবিক গবেষণা ও সামরিক আধিপত্য বিস্তারে। অথচ এই অর্থের অতি ক্ষুদ্র একটি অংশ ব্যয় করলেই বিশুদ্ধ পানির অভাবে মৃত্যু বরণ করা শিশুদের বাঁচানো যেত, বিশ্বজুড়ে গৃহহীনদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় নিশ্চিত করা যেত, কিংবা শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা যেত। কিন্তু বাস্তবতা হলো লোভ, ক্ষমতার মোহ ও আধিপত্যের লালসা আজ মানবিক চেতনাকে গ্রাস করে ফেলেছে।
আমরা ভুলে গেছি, মানুষ সৃষ্টি হয়েছে এক মহান উদ্দেশ্যে।
আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলেন “আমি মানুষ ও জিন জাতিকে সৃষ্টি করেছি একমাত্র আমার ইবাদতের জন্য।” (সূরা যারিয়াত, ৫৬)।
অথচ মানুষ আজ সেই লক্ষ্য থেকে সরে এসে ফেরাউনের পথ অনুসরণ করছে যেখানে অহংকার, গর্ব, জুলুম ও আত্মমর্যাদাহীনতা চরমে।
ফেরাউন এক সময় নিজেকে ঈশ্বর দাবি করেছিল। তার অধীন জাতির উপর সে যেভাবে অত্যাচার চালিয়েছিল, তা ইতিহাসে রোমহর্ষক দৃষ্টান্ত। কিন্তু তার সেই অহংকার তাকে রক্ষা করতে পারেনি। সমুদ্রে নিমজ্জিত হয়ে সে ধ্বংস হয়েছে, আর তার দেহ আল্লাহ চিরস্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করেছেন যেন তা মানুষের জন্য নিদর্শন হয়।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ বলেন --
“আজ আমি তোমার দেহকে রক্ষা করব, যেন তুমি তাদের জন্য নিদর্শন হও, যারা তোমার পরবর্তী যুগে আসবে।” (সূরা ইউনুস, ৯২)।
কিন্তু বিশ্ব আজ সেই নিদর্শন থেকেও শিক্ষা নিচ্ছে না। আধুনিক সময়ের বহু নেতা, রাষ্ট্রপ্রধান,ক্ষমতাবান ব্যক্তি যেন ফেরাউনের উত্তরসুরী—তারা নিজেদের কথায় আইন বানায়, মানবতারকথা ভুলে সামরিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য কায়েম করতে চায়। অথচ ইতিহাস সাক্ষ্যদেয়,কোনো জালিম চিরস্থায়ী হয়নি।
আল্লাহ কুরআনে শান্তির পথ নির্দেশ করেছেন। কুরআনের প্রকৃত শিক্ষায় রয়েছেন্যায়, ইনসাফ, দয়া, মানবতা ও ভ্রাতৃত্ব। যারা এই পথ অনুসরণ করে, আল্লাহ তাদের কল্যাণদেন। কিন্তু আজকের বিশ্ব উন্নয়নের নামে সেই পথকে উপেক্ষা করছে। ফলত দেখা যাচ্ছে যুদ্ধ, রক্তপাত, অনাহার, বৈষম্য, মানসিক চাপ ও আত্মঘাতী প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে।
আরব বিশ্বের দিকে তাকালে বোঝা যায় আল্লাহর নিদর্শন কেমন করে মানুষকে সতর্ক করছে। সিরিয়া, ইয়েমেন, লিবিয়া, ইরাক এই দেশগুলো এক সময় ছিল সমৃদ্ধ। কিন্তু নেতৃবৃন্দের সীমাহীন লোভ, স্বৈরাচার, ধর্মের অপব্যাখ্যা, এবং আল্লাহর হুকুম অমান্য করার ফলস্বরূপ আজ তারা ধ্বংসস্তূপে পরিণত। এসব দেশের জনগণ আজ উদ্বাস্তুর জীবন যাপন করছে। শিশুরা শিক্ষা হারিয়েছে, নারীরা নিরাপত্তাহীন, আর সমাজে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে। এসব নিদর্শন কেবল সংবাদপত্রের শিরোনাম নয়, বরং আমাদের জন্য এক মহা সতর্কবার্তা।
কুরআনের বাণী অনুসারে,
“আল্লাহ কোনো জাতির অবস্থা পরিবর্তন করেন না, যতক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থার
পরিবর্তন করে।” (সূরা রা’দ, ১১)।
আজ সময় এসেছে সেই আত্মসমালোচনার। জাতি, সমাজ ও বিশ্বনেতাদের উচিত নিজেদের পথ পুনর্বিবেচনা করা। শান্তি শুধুমাত্র অস্ত্র নির্মূল করে অর্জিত হবে না; বরং আল্লাহর পথ অনুসরণ, কুরআনের আলো গ্রহণ, এবং মানবতার ন্যায় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই আসবে প্রকৃত শান্তি।
মানুষের উন্নয়ন তখনই সফল, যখন তা মানবিকতা ও আত্মিক পরিশুদ্ধির সঙ্গে যুক্ত হয়। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কেবল সংখ্যার খেলা নয় তা হওয়া উচিত মানুষের কল্যাণ ও ইনসাফ নিশ্চিত করার মাধ্যম। আজ আমরা এমন এক সময়ে দাঁড়িয়ে, যেখানে অর্থ ও প্রযুক্তির বিস্ময়কর উন্নতি ঘটেছে, কিন্তু একই সঙ্গে মনুষ্যত্ব ও মানবিকতা নিম্নমুখী। এই বৈপরীত্যই বোঝায় আমরা ভুল পথে এগিয়ে চলেছি।
যুদ্ধ কখনোই সমাধান নয়। ইতিহাসে প্রতিটি যুদ্ধের পর এসেছে কান্না, হাহাকার, এবং এক বিশাল ক্ষয়ক্ষতি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, ভিয়েতনাম, আফগানিস্তান, ইরাক সব যুদ্ধই প্রমাণ করেছে, ঘৃণা দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। শান্তির জন্য চাই ভালোবাসা, সহমর্মিতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং সর্বোপরি আল্লাহর প্রতি ঈমান।
আমাদের প্রয়োজন একটি নতুন পথের। সেই পথ আল্লাহর পথ, কুরআনের পথ।
এই পবিত্র কিতাবে রয়েছে সকল সমস্যার সমাধান। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজব্যবস্থা সবকিছুর জন্য নির্দেশনা রয়েছে এই গ্রন্থে।
যদি বিশ্ব নেতারা আল্লাহর পথে ফিরে আসেন, তবে যুদ্ধ বন্ধ হবে, মানুষ বাঁচবে, এবং পৃথিবী হবে এক শান্তিময় নীড়।একটি শিশুর চোখে যদি শান্তির ছবি আঁকা হয়, একটি মা যদি সন্তানের নিরাপত্তা নিয়ে নিশ্চিন্ত থাকে, একজন বৃদ্ধ যদি শেষ জীবনে সমাজের সম্মান পায় তবেই বুঝব, উন্নয়ন সত্যিকার অর্থে হয়েছে। আর তা সম্ভব একমাত্র তখনই, যখন বিশ্বনেতারা তাদের হৃদয়ে আল্লাহর ভয় রাখবেন এবং কুরআনকে পথনির্দেশক হিসেবে গ্রহণ করবেন।
উপসংহারে বলা যায় এই পৃথিবী আল্লাহর সৃষ্টি, এবং তিনি সর্বশক্তিমান। মানবজাতির অহংকার, লোভ,দম্ভ সব কিছুরই পরিণতি রয়েছে। ফেরাউন, নমরুদ, হিটলার কারো নাম ইতিহাস আজ সম্মানের সঙ্গে উচ্চারণ করে না। যারা আল্লাহর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে, তাদের পতন হয়েছে নিশ্চিত। ঠিক তেমনি, যারা আল্লাহর পথে চলে মানবতার কল্যাণ করেছে তাদের নাম ইতিহাস শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে।
তাই হে বিশ্বনেতারা! আজও সময় আছে। ফিরে আসুন, এক আল্লাহর পথে। মুছে ফেলুন যুদ্ধের চিন্তা, ধ্বংস করুন সমস্ত মারণাস্ত্র, গড়ে তুলুন এক শান্তির বিশ্ব যেখানে মানুষ মানুষের জন্য দাঁড়ায়, ভালোবাসা ঘৃণাকে জয় করে, এবং সত্য, ন্যায় ও মানবতার আলোয় আলোকিত হয় গোটা পৃথিবী।
শান্তির বিরুদ্ধে নয়, শান্তির পক্ষে দাঁড়ান। কারণ, একমাত্র PEACE-ই পারে মানবজাতিকে রক্ষা করতে, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করতে এবং চিরস্থায়ী পরকালের মুক্তি নিশ্চিত করতে।
আন্তরীক ধন্যবাদ,
আসসালামুয়ালাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহী ওয়া বারাকাতু।
MD KHALIL